প্রশ্নঃ কত সালে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রথম প্রকাশিত হয়?
[ বিসিএস ৩৮তম ]
'মেঘনাদবধ কাব্য' হলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক মহাকাব্য। এটি ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয়।
রচনার পটভূমি ও অনুপ্রেরণা
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ। তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের বিশেষ করে গ্রিক ও রোমান মহাকাব্যের আদলে বাংলা ভাষায় একটি মহাকাব্য রচনার স্বপ্ন দেখতেন। সংস্কৃত মহাকাব্য রামায়ণের কাহিনি অবলম্বনে তিনি এই কাব্য রচনা করেন, তবে এর উপস্থাপন এবং চরিত্রের চিত্রণে তিনি মৌলিকত্ব ও আধুনিকতার ছাপ রেখেছেন। তিনি রামায়ণের প্রধান চরিত্র রামকে নয়, বরং রাবণের পুত্র মেঘনাদকে (ইন্দ্রজিৎ) নায়ক হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা সে সময়ের প্রচলিত ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল।
কাব্যিক বৈশিষ্ট্য
- অমিত্রাক্ষর ছন্দ: 'মেঘনাদবধ কাব্য' অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত। এটি বাংলা কাব্যে মধুসূদন দত্তের এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এই ছন্দে প্রতিটি চরণের শেষে মিল থাকে না, কিন্তু চরণগুলো সুনির্দিষ্ট মাত্রাবিন্যাসে সজ্জিত থাকে, যা কাব্যে এক ধরনের গাম্ভীর্য ও গতিময়তা এনেছে। এই ছন্দের মাধ্যমে তিনি বাংলা কাব্যে ছন্দের বন্ধনমুক্তি ঘটিয়েছিলেন।
- সর্গ বিভাজন: কাব্যটি মোট নয়টি সর্গে বিভক্ত। প্রতিটি সর্গের নামকরণ করা হয়েছে কাহিনির প্রধান ঘটনা বা চরিত্রের নামে, যেমন: অভিষেক, শক্তিশেল, হত্যা ইত্যাদি।
- ট্র্যাজিক নায়ক: মধুসূদন এই কাব্যে মেঘনাদকে একজন ট্র্যাজিক নায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন। রামায়ণ অনুসারে মেঘনাদ খলচরিত্র হলেও, মধুসূদনের কাব্যে সে স্বদেশপ্রেমী, বীর এবং আত্মমর্যাদাশীল এক মহান যোদ্ধা। তার মৃত্যুতে পাঠকের মনে গভীর শোক ও সহানুভূতি সৃষ্টি হয়।
- পুরাণ ও আধুনিকতার মিশ্রণ: যদিও কাহিনি রামায়ণ থেকে নেওয়া, মধুসূদন এতে আধুনিক মানবিকতা, বীরত্ব এবং ট্র্যাজেডির উপাদান যোগ করেছেন, যা কাব্যটিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে।
- অলঙ্কার ও চিত্রকল্প: কাব্যে বহু পৌরাণিক উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং হৃদয়গ্রাহী চিত্রকল্পের ব্যবহার দেখা যায়, যা এর সাহিত্যিক মূল্যকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রধান চরিত্রসমূহ
- রাবণ: লঙ্কার রাজা এবং মেঘনাদের পিতা।
- মেঘনাদ (ইন্দ্রজিৎ): রাবণের বীর পুত্র এবং কাব্যের প্রধান চরিত্র।
- প্রমীলা: মেঘনাদের স্ত্রী, এক বীরাঙ্গনা নারী।
- মন্দোদরী: রাবণের প্রধানা মহিষী এবং মেঘনাদের জননী।
- বিভীষণ: রাবণের অনুজ ভ্রাতা, যিনি রামের পক্ষে যোগ দেন।
- লক্ষ্মণ: রামের ভাই।
- রাম: অযোধ্যার রাজা।
- সীতা: রামের স্ত্রী।
- সরমা: বিভীষণের স্ত্রী।
গুরুত্ব ও প্রভাব
'মেঘনাদবধ কাব্য' প্রকাশের পর বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। এটি বাংলা কাব্যকে ধ্রুপদী মহাকাব্যের স্তরে উন্নীত করে এবং বাঙালি পাঠকদের কাছে মহাকাব্যের নতুন স্বাদ তুলে ধরে। এটি পরবর্তীকালে বহু কবিকে মহাকাব্য রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি চিরস্মরণীয় সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত হয়।